রহিঙ্গাদের পরিচয় সম্পর্কে অয়ানা তথ্য """""""সবার জন্য উন্মুক্ত ""'""""""""
মায়ানমারের রাখাইন (পূর্বনাম আরাকান) রাজ্যের প্রধান দুটি জাতি হল রোহিঙ্গা ও মগ। রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলিম, অন্যদিকে মগরা ধর্মে বৌদ্ধ। বাংলায় প্রচলিত “মগের মুল্লুক” প্রবাদটি আরাকানের এই মগদের সম্পর্কেই। মগদের অতীতের জলদস্যুতার কারণে এই প্রবাদটি প্রচলিত হয়। (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। ইতিহাস থেকে জানা যায় অতীতে আরাকান ও বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকাটি একসাথেই ছিল এবং এখানে একই জাতীর লোক বসবাস করতো। সপ্তম শতাব্দী থেকেই এই অঞ্চলের সাথে আরবের মুসলিম বণিকদের যোগাযোগ ঘটে। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ্যে সিংহাসনে বসেন রাজা নারমিখলা। এরপর কয়েকবছর পর বার্মার রাজা আরাকান আক্রমণ করলে রাজা নারমিখলা পালিয়ে গৌড়ে আশ্রয় নেন। গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহ আরাকান উদ্ধারে সেনাবাহিনী পাঠান। এই যুদ্ধে গৌড়ের সেনা জয়ী হলে নারমিখলা ১৪৩০ সালে রাজ্য ফিরে পান। গৌড়ের সুলতানকে নিয়মিত কর দেওয়ার চুক্তি করে রাজা হন ও ম্রক-ইউ রাজবংশের পত্তন করেন। রাজা নারমিখলার ইসলাম গ্রহণ করে নতুন নাম নেন মুহম্মদ সুলাইমান শাহ। এসময় গৌড় থেকে অনেক মুসলিম এই এলাকায় যান এবং এখানকার ‘রোসাং’ জাতিও ইসলাম গ্রহণ করে। এই রোসাংরাই বর্তমানে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। নারমিখলা এসময় গৌড়ের অনুসারে মুদ্রা চালু করেন, যার একদিকে থাকতো বার্মিজ বর্ণ অন্যদিকে ফার্সি ভাষায় কলেমা। তবে আরাকানের গৌড়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ছিল শুধুমাত্র নারমিখলার আমলেই। রাজা নারমিখলার পরবর্তী শাসকেরা গৌড়ের সংস্রব এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এরপর দিল্লির শাসন মুঘলরদের হাতে এলে ১৫৩০ সালে আরাকানের রাজা জেবুকশাহ গৌড়ের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। মুঘলদের ভয়ে বন্ধুত্ব গড়েন পর্তুগীজ জলদস্যুদের সাথে। পর্তুগীজদের সহযোগিতায় আরাকানের মগ বৌদ্ধদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এক দুর্ধর্ষ নৌবাহিনী। এসময় থেকে মগেরা জলদস্যুতাও শুরু করে। আরাকানকে সমৃদ্ধ করতে এসময় মগেরা বাংলা থেকে জোর করে বাঙালি মুসলিমদেরকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে লাগাত ও সেই জঙ্গলে তাদেরকে দিয়ে কৃষিকাজ করাতো। এই বাঙালি মুসলিমরাও এখানে থেকে যায়। কালক্রমে বাঙালি ও রোসাং মুসলিমরা একসাথে মিশে যায়। পরবর্তীতে এরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত হয়।
রোহিঙ্গাদের প্রথম ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে ১৭৮৪ সালে যখন বার্মিজরা আরাকান আক্রমণ করে। পরাজিত হন আরাকানরাজ। এসময় থেকেই বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। অনেক রোহিঙ্গা ও মগ পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর ব্রিটিশরা আরাকান দখল করলে রোহিঙ্গা ও মগদের অনেকেই আরাকানে ফিরে যায়। কৃষিকাজের জন্য প্রচুর বাঙ্গালিকেও নিয়ে যায় ইংরেজরা। এসময় থেকেই এখানে রোহিঙ্গা-বাঙ্গালী ও মগদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে থাকে। মগ ও বার্মিজরা বৌদ্ধ হওয়ায় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ও বাঙ্গালিরা মুসলিম হওয়ায় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলে বার্মিজরা প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। (সুত্রঃউইকিপিডিয়া) এরপর ১৯৪৬ সালে রোহিঙ্গা নেতারা মুহম্মদ আলি জিন্নাহর সাথে দেখা করে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের সাথে আরাকানকে যুক্ত করার আবেদন জানান। কিন্তু জিন্নাহ তাতে রাজি হন নি। তারপর রোহিঙ্গারা আরাকানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কয়েকটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে আরাকান বার্মার দখলেই চলে যায়। কিন্তু বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করে বার্মা সরকার। এরমধ্যে মারত্মক ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৬ ও বর্তমান সালের অত্যাচার।
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে সেদেশ থেকে বহিষ্কার করতে ১৯৭৮ সালে চালায় “অপারেশন কিং ড্রাগন’। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ২ লক্ষ রোহিঙ্গা। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এদের অনেকে আবার আরাকানে ফিরে যায়। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে রোহিঙ্গাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি’ নামে অপারেশন চালায় সেনাবাহিনী। এবারও অসংখ্য মানুষ নিহত হন, ধর্ষিত হন অসংখ্য। অত্যাচারের মাত্রা এতটাই ছিল যে জীবন বাঁচাতে প্রায় আড়াই লাখ আশ্রয় নেন বাংলাদেশে, ২ লাখ পালিয়ে যান পাকিস্তানের করাচিতে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ। এবারও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের অনেকেই ফিরে যান আরাকানে। তবে এখনো বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন, পাকিস্তানে রয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ, সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশগুলিতে রয়েছেন প্রায় ৪ লাখ, থাইল্যান্ডে রয়েছেন ৫০ হাজার, মালায়েশিয়ায় রয়েছেন প্রায় ২ লাখ, এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, চিন, ইংল্যান্ড, নেপাল, প্রভৃতি দেশেও রয়েছেন কয়েক লাখ। রোহিঙ্গাদের মোট জনসংখ্যা স্পষ্ট করে জানা যায় নি। মায়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে রয়েছেন প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে উত্তর আরাকানে রয়েছে প্রায় ৮ লাখ। এই ৮লাখের উপরেই গত কয়েকদিন ধরে অত্যাচার চলছে। সেনাবাহিনী দিয়ে ঘেরা এই এলাকা যেন এক জেলখানা। এখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মায়নামার প্রশাসন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অনেক আগেই বাতিল করেছিল। এমনকি শান্তিতে নোবেলজয়ী মায়ানমারের প্রধান নেত্রী আউং সান সু কি-ও রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমারের নাগরিক মনে করেন না। তাদের কাছে রোহিঙ্গারা বিদেশি, কিন্তু আরাকান বিদেশ নয়, নিজেদের দেশেরই অংশ! অথচ আরাকানই হল রোহিঙ্গাদের আদি বাসভূমি।
১৯৭৪ সালে আরাকানের নাম বদল করে রাখা হয় ‘রাখাইন’। রাখাইন শব্দটি এসেছে রাক্ষপুরা (সংস্কৃত রাক্ষসঃপুরা) থেকে, পালিশব্দ রাক্ষপুরার অর্থ ‘রাক্ষসদের ভুমি’ (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। ১৯৮২ সালের একটি আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার। জানানো হয়, সরকারী অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গারা দেশের মধ্যে ভ্রমণ করতে পারবে না, জমি কিনতে পারবে না, দুটির বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। রোহিঙ্গাদেরকে কোনোরকম পড়াশুনার সুযোগ দেয় না বার্মা সরকার। তবে স্থানীয়দের উদ্যোগে প্রায় সব গ্রামেই মক্তব ও মাদ্রাসা আছে। এগুলিতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে শিশুরা। উত্তর রাখাইনে সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গাদের উপর বিভিন্নরকম কর আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। রোহিঙ্গাদেরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত জাতি।সরকারী অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গারা বিয়ে পর্যন্ত করতে পারে না। রাস্তার কাজে ও বিভিন্ন নির্মাণ কাজে রোহিঙ্গাদের কাজ করা বাধ্যতামূলক। এমনকি শিশুদেরকেও এসব কাজে যোগ দিতে হয়।
অভাবের কারণে, সরকারী কাজে বেতন না পাওয়ার কারণে রোহিঙ্গা যুবকদের অনেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। একারণে বাংলাদেশ সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে অনিচ্ছুক। বাংলাদেশের দাবী, রোহিঙ্গারা এদেশে এসে বিভিন্ন অপরাধমূলক ও সমাজবিরোধী কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। নতুন করে এদেরকে আরও আশ্রয় দিলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখানে গড়ে ওঠে বৌদ্ধদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘৯৬৯ মুভমেন্ট’। ২০০১ সালে এতে যোগ দেন আসিন উইরাথু নামে এক মুসলিমবিরোধী বৌদ্ধ ভিক্ষু। এসময় থেকে রোহিঙ্গাদের অবস্থা চরমে ওঠে। সরকারের মদতেই বৌদ্ধরা হামলা চালাতে থাকে রোহিঙ্গাদের উপর। ২০১২ সালে প্রধানত আসিন উইরাথুর উদ্যোগেই মারাত্মক দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় দুপক্ষই। তবে রোহিঙ্গাদেরই বেশি ক্ষতি হয়। তারা ঘরবাড়ি হারিয়ে সবদিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের দাঙ্গাতেও সরকারের মদত থাকার জন্য বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে সরকারী বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর সরাসরি হামলা চালায়। কিন্তু এবার সরকারী সেনা যেভাবে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা অতীতের সমস্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঘরছাড়া। আগে এসব খবর খুব একটা পাওয়া যেত না। কেননা সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে বাংলাদেশ-মায়ানম
ার সীমান্তে গিয়ে সাংবাদিকরা বাস্তুহারাদের কাছে অত্যাচারের কাহিনি শুনছেন। বলতে বলতে প্রায় সকলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কেউ কেউ গ্রামে মোবাইল ফোনে অত্যাচারের ভিডিও করেছেন, সেগুলি তুলে দিচ্ছেন সাংবাদিকদের হাতে। যা দেখছে বিশ্ববাসী। দেখছেন বিশ্বনেতারা।
কিন্তুএতকিছুর পরেও কি বিশ্ববিবেক জাগবে না? ঘুম ভাঙবে না বিশ্বমোড়লদের? বেঁচে থাকার অধিকার পাবে না একসময়য়ের স্বাধীন রোহিঙ্গারা? নির্যাতিত রোহিঙ্গারাদের অনেকেই এই আশা ছেড়ে দিয়েছেন যে, তারা তাদের বাসভূমিতে স্বাধীনতা লাভ করবে। বরং জেলখানার মত আরাকান থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের প্রতি তাদের আকুল আবেদন,”দয়া করে আমাদেরকে সীমান্ত খুলে দিন। আমরা আপনাদের কাছে ভাত চাই না, কাপড় চাই না, টাকা চাই না। চাই শুধু একটু বাঁচতে। আমাদের দয়া করুন ভাই, দয়া করুন।“
তথ্যসূত্রঃ
১। রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস- অধ্যাপক এন এম হাবিবুল্লাহ, বাংলাদেশ
২। উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন পাতা
৩। বিবিসি-এর বিভিন্ন প্রতিবেদন ও ভিডিও
৪। আলজাজিরা-এর বিভিন্ন প্রতিবেদন ও ভিডিও
৫। Dhaka Times, Outlook, Washington Post ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম
আলি মোস্তাফা
কোচবিহার
24/11/2016
[লেখাটি আসলে ২০১৬ সালে উত্তরের সারাদিনে প্রকাশিত আলি মোস্তাফার লেখা "রোহিঙ্গা নির্যাতনঃ মানবতার আর্তনাদ মায়ানমারে" এর অংশ। মাঝখানে দু-একটি বাক্য এডিট করা হয়েছে। মূল লেখার লিঙ্ক http://www.alimostafa.i
n/2016/12/blog-post_4.html ]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন